গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করাটা ভাসানীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আর পাশাপাশি আরেকটা বিষয় হলো গণঅভ্যুত্থানের সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে একইসঙ্গে বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবার ভিত্তিটা তিনি স্থাপন করে দিয়েছেন। ভাসানী যদি না থাকতেন, শেখ মুজিবুর বলে কেউ থাকতেন না।
Published : 12 Dec 2024, 05:01 AM
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে প্রথমে যেটা মনে আসবে সেটা হলো, তিনি কিন্তু ‘জাতিবাদী নেতা’ নন। যে অর্থে শেখ মুজিবুর রহমান ‘জাতিবাদী নেতা’, ভাসানী কিন্তু তেমন ছিলেন না। প্রথমত তিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী। বিভিন্ন দিক থেকে আন্তর্জাতিক ছিলেন।
এখন প্রশ্ন আসে কোন দিক থেকে আন্তর্জাতিক ছিলেন? তিনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে লড়েছেন। সেটা করেছেন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে যারা শ্রমশক্তি বিক্রি করে পুঁজির নাটবল্টু হয়ে বেঁচে থাকে তাদের পক্ষে; তারা কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা শ্রেণী, ইত্যাদি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার দ্বন্দ্বও এই গোড়ার বৈষম্যহীনতার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ সেই আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে যার ফলে একদিকে উৎপাদনের উপায়, টেকনলজি ও সভ্যতার ফসল অল্প কিছু পরিবার বা কোম্পানির কুক্ষিগত হয় আর বাকি দুনিয়ার মানুষ তাদের গোলামি করে। এই গোলামির জিঞ্জির ভাঙবার জন্য বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে মওলানা তাদের রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরু। বামপন্থার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা বা রুহানিয়াতের কোন প্রেরণা ছিল না। মার্কস পরবর্তী যে সকল বৈপ্লবিক চেষ্টা হয়েছে তাদের ব্যর্থতার কারণ মানুষ স্পিরিচুয়াল বা রুহানি গুণ সম্পন্ন জীব সেই বাস্তবতা অস্বীকার করা। রাজনৈতিক কর্তাসত্তাকে বস্তুজগতের ক্যাটাগরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, দেশকালপাত্রের বিধিবদ্ধ বস্তুগত জীবনের বাইরেও মানুষ রুহানি প্রেরণায় ইতিহাসে ভূমিকা রাখতে পারে ইসলাম থেকে— বিশেষত নবী-রসুল-অলি-আউলিয়া-পীর-মুর্শিদের জীবনী থেকে তিনি সেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। মওলানা আজাদ সুবহানি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শেষ জীবনে ভাসানী নতুন ভাবে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের নতুন রুহানি নীতি ও কৌশল হাজির করেছিলেন। ইত্যাদি নানান কারনে তাঁর দর্শন ও রাজনীতির তাৎপর্য আন্তর্জাতিক। তিনি জাতীয় নেতা নন, আন্তর্জাতিক তো বটেই, তদুপরি অনাগত বিশ্বেরও নেতা।
তিনি যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর যে রাষ্ট্র চিন্তা, তাঁর যে সমাজ চিন্তা, সেটা অত্যন্ত মৌলিক। আমাদের সবার আগে বুঝতে হবে, ভাসানী সম্পর্কে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন খণ্ডিতভাবে করি। আমাদের সমাজে তাঁর সম্পর্কে দুটো ভাগ লক্ষ্য করি– একটা ভাগে আছে, তথাকথিত বামপন্থীরা। এই বামরা বোঝাতে চায়, ভাসানী মাত্রই একজন বাম– একজন লাল। ফলে তাদের তরফে আমাদের একজন ‘লাল ভাসানী’ আছে। সেই ‘লাল ভাসানী’র বয়ানও আছে, ‘লাল ভাসানী’ নিয়ে লেখালেখিও আছে যথেষ্ট।
অন্য যে ধারাটি আছে, সেই ধারার সঙ্গে আমাদের শিক্ষিতমহল পুরোটা পরিচিত নন। দ্বিতীয় ধারার ভাসানী হচ্ছেন ‘সবুজ ভাসানী’, যাদেরকে আমরা পীর বলি। আমরা অনেকে হয়তো জানি না ভাসানী কিন্তু পীরও ছিলেন, তাঁর মুরিদের সংখ্যাও কিন্তু অসংখ্য। এই যে পীর এবং পীরের জীবন, সেই ভাসানীর জীবন অত্যন্ত বিনয়ী, বিনীত একটা জীবন। ইহলৌকিক কামনা, বাসনা, মোহ ও স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে এক অসাধারণ জীবন ভাসানী চর্চা করে গেছেন। ফলে তাঁর বিপুল সংখ্যক মুরিদ রয়েছেন। এ হলো তাঁর সম্পর্কে আমাদের সমাজে বিদ্যমান দুটো ধারণা। এই ভাসানী ‘লাল’ ভাসানী’ নন। ইনি ‘সবুজ ভাসানী’। পীর। রুহানিয়াতের রাহবার।
ভাসানী কিন্তু দুটোই একসঙ্গে। একদিকে তিনি যেমন, মার্কস ও লেনিনীয় অর্থে রেভ্যুলেশনারি ঠিক তেমনি তিনি অনাথ নিরাশ্রয় দিশাহারা মানুষের পীর, তাদের পথ প্রদর্শক। দ্বিতীয় ভাসানীকে শিক্ষিত শ্রেণী খুব কমই চেনে। রেভ্যুলেশন অর্থে তাঁর বিপ্লবী দিকটা যেমন আছে, তেমনি তাঁর অন্য ‘সবুজ’ দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক কৌশল– বিশেষত রাষ্ট্রক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করবার কলাকৌশল আবিষ্কারের ক্ষেত্রে উপমহাদেশে তাঁর জুড়ি ছিল না। শুধুমাত্র গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তিনি নতুন ধরনের বিভিন্ন নজির স্থাপন করেছেন উপমহাদেশে, তা না কিন্তু। একটি কৃষি প্রধান সংস্কৃতির মধ্যে শ্রুতি ও কণ্ঠ নির্ভর জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার কৌশল তিনি নানাভাবে প্রদর্শন করেছেন। তিনি না থাকলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অসম্ভব ছিল। এই যেমন ঘেরাও আন্দোলন, এটা কিন্তু ভাসানীর আবিষ্কার। অথবা পুলিশ এসে যখন কোনো মিছিল করতে দিচ্ছে না, তখন হঠাৎ করে ভাসানী আল্লাহু আকবার বলে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলেন। আন্দোলনের এমন নানাবিবিধ দুর্দান্ত কৌশল তিনি আবিষ্কার করেছেন। এমন উদাহরণ দিতে গেলে মেলা গল্প চলে আসে।
আরও বিখ্যাত গল্পটা হলো এই, তিনি যখন কোনো সম্মেলন করতেন, সেই সম্মেলনে কৃষকরাই কিন্তু চাল, ডাল, ছাগল, গরু নিয়ে আসতেন। তাঁর সম্মেলনে কৃষক কিন্তু সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। ফলে ভাসানীর গণঅভ্যুত্থানটা ছিল মূলত এমন একটা চর্চা, যাকে আমরা রাজনৈতিক সাহিত্যে গণসার্বভৌমত্ব বিকাশের চর্চা– অর্থাৎ জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়কে ‘বর্তমান; বা বাস্তব করে তোলার রাজনৈতিক কৌশল বলতে পারি। যে রাজনৈতিক পরিসরটা তিনি গড়ে তুলতে চাইতেন– সেখানে জনগণ অংশগ্রহণ করত সরাসরি, পরোক্ষভাবে নয়। এমনকি তাদের খাদ্য সংস্থান, থাকার ব্যবস্থা পুরোটাই কিন্তু ওই কৃষক নিজেরাই করতেন। শুধু ভাসানীর সাংগঠনিক পদ্ধতি নিয়েও যদি আমরা আলোচনা করি, সেটা নিয়ে দীর্ঘ কথা বলা যাবে, কত যে অভিনব ছিলেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করাটা ভাসানীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আর পাশাপাশি আরেকটা বিষয় হলো গণঅভ্যুত্থানের সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে একই সঙ্গে বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবার ভিত্তিটা তিনি স্থাপন করে দিয়েছেন। ভাসানী যদি না থাকতেন, শেখ মুজিবুর বলে কেউ থাকতেন না। এটা খুব পরিষ্কার করে আমাদের বুঝতে হবে। এই যে দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনের ফলে আমরা ভাসানীকে মুছে ফেলেছি, কিন্তু তাঁকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
শেখ মুজিব যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি হলেন, তিনি যে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন তার পক্ষে কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কাছে প্রমাণ ছিল। সেই সব প্রমাণ মুজিবের কাছে হাজির করা হয়েছিল, তারা কিন্তু তাঁকে গিয়ে দেখিয়েছে যে, আপনার ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের রিপোর্টে আছে। সেই রিপোর্ট দিয়ে বিচার হলে কিন্তু আপনি দায়ী হবেন। সৌভাগ্যক্রমে, সেসময় যিনি গোয়েন্দা প্রধানের তরফ থেকে কথা বলেছিলেন, মুজিবের প্রতি তাঁরও একটা দরদ হয়েছিল। তিনিও বাঙালি। তিনি বলেছিলেন যে আপনি যদি এই পাকিস্তান সামরিক শাসকের কাছে ক্ষমা চান, তাহলে আমি আপনার রাজনৈতিক জীবনটা কিছুটা হলেও রক্ষা করার চেষ্টা করব। আপনার কিন্তু ক্ষমা চাইতে হবে লিখিতভাবে।
ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত করবেন, কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এই গল্পটা আমি যতটুকু জানি তা কিন্তু সঠিক বলেই জানি। শেখ মুজিবুর রহমান অপরাধ করেছেন, তিনি ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠিও লিখেছেন। কিন্তু সে সময় যিনি তাঁকে এই চিঠিটা লিখতে বলেছিলেন, তাঁর কাছে এটা খারাপও লেগেছিল যে বাংলাদেশের একজন নেতা, যিনি সর্ব-পাকিস্তানে গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠছেন, আগামী দিনে হয়তোবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হবেন, এই একটা চিঠি দিয়ে তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা তিনি চাননি। তখন তিনি একটা তথ্য শেখ মুজিবকে দিলেন। তিনি বললেন, “আপনি কি জানেন যে আপনার জন্য সমস্ত দেশের জনগণ নেমে পড়েছে এবং তাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মওলানা ভাসানী।”
মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাসানী কী বলছেন?”
তখন তাঁকে বলা হোলো, “ভাসানী বলছেন, জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।”
শেখ মুজিবুর রহমান এই তথ্য পাবার পরে ক্ষমা চেয়ে লেখা ওই চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। এটাই হলো আমাদের ইতিহাস। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ যে ইতিহাস মুছে ফেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘মহানায়ক’ বানিয়েছে। শেখ মুজিব নামে কোনো রাজনৈতিক নেতা তৈরি হত না যদি মওলানা ভাসানী না থাকতেন। এই ইতিহাস আমাদের মনে রাখতে হবে।
এখন আমি একটু তাত্ত্বিক কথা আলোচনা করব, খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাসানী বলেছেন, দুটো শত্রু আছে আমাদের। এক নম্বর দুষমণ হোল কম্যুনিস্টরা। কম্যুনিস্টরা কেন শত্রু? কারণ কম্যুনিস্টরা বলে যে, সম্পত্তিতে কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারবে না। কিন্তু তারা ওই ব্যক্তিগত মালিকানা ভোগ করে, গরিবের সম্পত্তিটা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রূপান্তরিত করে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বানিয়ে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কম্যুনিজমের দিক থেকে তিনি যে ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার ক্রিটিক করছেন। কম্যুনিস্টরা যদিও দাবি করে যে সম্পত্তিতে কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারবে না। কিন্তু তারা রাষ্ট্র দ্বারা মূলত ব্যক্তির যে অধিকার জমিতে, কৃষকের যে অধিকার জমিতে– সেই অধিকারটা তারা হরণ করে– সেটা করে এই রাষ্ট্রীয় মালিকানার দাবি করে। সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কায়েম নয়। রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কায়েম করে কৃষকের সম্পত্তি হরণ করা কমিউনিজম নয়। ফলে তিনি বাংলাদেশের তথাকথিত সমজতন্ত্রী কম্যুনিস্টদের বিরোধী ছিলেন।
আর তিনি তথাকথিত আলেম-ওলামাদেরও বিরোধী ছিলেন। কেন তিনি বিরোধী ছিলেন? ভাসানী বলতেন, আলেম-ওলামারা সব সময় দাবি করে এই দুনিয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ, দুনিয়ার সমস্ত কিছুর মালিক হলেন আল্লাহ। কিন্তু রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে, নিজের সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে কিন্তু তারা আর এটা বলেন না। ঠিকই আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নিজের নামে জমি রেজিস্ট্রি করেন। এইসব ভুয়া আলেম, আসলে কিন্তু ইসলামের পথে নাই। মূলত তারা মজলুমের দুশমন। ফলে কৃষক-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীদের এদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যারা মুখে বলে যে সমস্ত দুনিয়ার মালিক আল্লাহ, আমাদের সহায়-সম্পত্তি, আমাদের জীবন সকল কিছুর মালিক আল্লাহ, আসলে কিন্তু তারা এটা মোটেও বিশ্বাস করেন না। কারণ তারা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তিতেই ঈমান রাখেন।
‘মালিকানা’-র তর্কটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আর একটা খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার আমাদের বুঝতে হবে। ইসলামে কিন্তু মালিকানার ধারণা নাই, কিন্তু অধিকারের ধারণা আছে। যদি কৃষকের কাছে জমিটা থাকে, সেই জমিটা কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে আপনি নিয়ে যেতে পারবেন না, কেড়ে নিতে পারবেন না। উৎপাদনের উপায়ে উৎপাদনকারীরই অধিকার। এটা তাঁর জীবিকার উপায়। ফলে ইসলামে কিন্তু বলে, কারো রিজিক আপনি ধ্বংস করতে পারেন না। রিজিকের বিরোধী হতে পারবেন না। ফলে যেসব আলেম-ওলামারা গরিবের, মজলুমের রিজিক রক্ষা করেন না, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না, জালেমের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না, মজলুমের পক্ষে দাঁড়ান না, মওলানা ভাসানীর কাছে তারা কেউই মুসলিম পদবাচ্য নন। এই ইসলামকে তিনি রিজেক্ট করে দিয়েছেন। এই ইসলামকে তিনি কিন্তু গ্রহণ করেননি। সেই জায়গায় তিনি যেটা বলেছেন, আমি যে ইসলাম গ্রহণ করতে চাই, তার যে মর্ম, তার যে মহিমার দিক, সেই মহিমার দিকটা হচ্ছে পালনবাদ।
এই ‘পালনবাদ’টা কী? এটাই হলো ‘রবুবিয়াত’। আল্লাহ তো কখনো বলেন না, এটা ব্যাটা তুই হিন্দু, তোর জন্য আগামীকাল কিন্তু সূর্য বন্ধ থাকবে, আলো বন্ধ থাকবে। তুমি খৃষ্টান, তোমার জন্য আগামী দিনে নদীর পানিতে আর স্রোত বইবে না। বৃষ্টির ধারা নেমে আসবে না। আল্লাহ তো এটা বলেন না। তিনি সকলকেই পালন করেন। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জীব-অণুজীব সবকিছুকেই তিনি পালন করেন। এই যে ‘রবুবিয়াত’ বা প্রতিপালনের ঐশ্বরিক গুণ– এই যে পালন করার স্বভাব, পালন করার ফিতরা– এই গুণ হলো স্বয়ং আল্লাহর গুণ এবং এই গুণের ভিত্তিতেই আমাদেরকে আগামী দিনের সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে হবে। সেই রাষ্ট্রটা কেমন হবে? সেটা হবে ‘পালনবাদী রাষ্ট্র’। সেই রাষ্ট্র শুধুমাত্র মানুষকে পালন করবে তা নয়, সমস্ত সৃষ্টি-জগৎকে পালন করবে, জীব-অনুজীব, জন্তু, প্রাণী, পাখি, পাখ-পাখালি সমস্ত কিছুকেই রাষ্ট্র পালন করবে। কারণ ইসলাম বলে, আমরা দুনিয়াতে এসেছি, আল্লাহর খলিফা হিসেবে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। ফলে আল্লাহর তরফ থেকে এ সমস্ত সৃষ্টিজগৎকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
ভাসানীর এই বক্তব্য, তাঁর এই দর্শন আজকে সারা পৃথিবীতে গৃহীত। ক্লাইমেট চেঞ্জ বলুন, গ্রহের বিপর্যয় বলুন ভাসানীর রবুবিয়াতের ধ্বনি সর্বত্র ধ্বণিত। এটাই ইসলামের বাণী। আগামী রাজনীতির রণধ্বণি। গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমস্ত কিছুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, পালন করতে হবে। পালন করার একটা দায় আছে মনুষ্য প্রজাতির। মনুষ্য প্রজাতি যে পালনটা করবে, সে পালনের ক্ষেত্রে তার আত্মার মধ্যে একটা রুহানি স্ফূর্তি থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে তার একটা আত্মিক জায়গা থেকে সে এই কাজটি করবে। এটা কিন্তু মওলানা ভাসানী আমাদেরকে বলে দিয়ে গেছেন। ফলে ক্লাইমেট চেঞ্জ যখন আমরা আলাপ করতে যাই, প্রাণ-প্রকৃতির বিপর্যয় নিয়ে যখন লড়াই করতে যাই, তখন আমাদের মওলানা ভাসানীর কথা মনে পড়ে। এজন্যই তিনি আন্তর্জাতিক।
শুধু আজকের জন্য নয়, আগামী দিনের লড়াইয়ে মওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ বা ‘রবুবিয়াত’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একটা গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের ধারা হিসেবে হাজির হবে।
আরেকটা যুক্তি দিয়ে শেষ করব। আমরা টমাস হব্সের নাম জানি, তিনি খুব বড় একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-দার্শনিক। টমাস হব্স বলছেন যে রাষ্ট্রের ধারণা হলো একটা ‘সিকিউরিটি স্টেট’-এর ধারণা। ‘শাসনবাদ’, মানে রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ হলো শাসন করা। কেন শাসন করে? কারণ আমরা সব মানুষ মারপিট করি, ফ্যাতনা-ফ্যাসাদ করি, মানুষের সমাজ একটা জঙ্গলের মতন, জন্তু-জানোয়ারের মতো লড়াই করি আমরা। ফলে আমাদের জন্য একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র দরকার। সেই রাষ্ট্রের কাছে আমরা নিজেদের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিই। নিজেদের সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের কাছে সমর্পন ও বিকিয়ে দিয়ে আমরা রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চাই, এটা এসেছে ‘সিকিউরিটি স্টেট’-এর ধারণা থেকে।
দেখা যাচ্ছে, আমাদের মওলানা ভাসানী অত্যন্ত সহজ পালনবাদের দ্বারা টমাস হবসের ‘সো কলড সিকিউরিটি স্টেট’ তত্ত্বকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছেন। যেহেতু তিনি দার্শনিক ছিলেন না, একাডেমিক কেউ ছিলেন না, ফলে তাঁর চিন্তার গভীরতা, তাঁর চিন্তার বিশাল যে পরিসর, সেটা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের মারাত্মক চিন্তার ঘাটতি আছে। এখন আমরা এই চিন্তার ঘাটতি কাটিয়ে তুলছি এবং এটা আমরা কাটিয়ে তুলব।
শেষ কথাটা বলি, মওলানা ভাসানী বলেছিলেন যে ফারাক্কা ভেঙে দিতে হবে। এটা কিন্তু তিনি তামাশা করে বলেননি। এটা কিন্তু ঠিকই বলেছেন, আসলেই এটা তিনি ভেঙে দিতে চেয়েছেন। কেন ভেঙে দিতে চেয়েছেন? এটা ভারতবিরোধিতার জন্য নয়, ফারাক্কা ভেঙে দেওয়ার ইচ্ছে মানে ভারতের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এমনটা ভুল ধারণা। ভাসানী কিন্তু সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক অর্থে ভারতবিরোধী কোনো লোক ছিলেন না। সমস্ত উপমহাদেশকে কেন্দ্র করে তাঁর চিন্তা ছিল। ফলে ওই দেশের, ভারতের জনগণেরও নেতা তিনি। ভারতের মজলুম যারা, তাদের নেতা তিনি। তিনি এটি ভাঙতে চেয়েছেন, কারণ এই ফারাক্কা বাঁধ শুধু বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর বলে নয়, এটা বিহারের জন্য ক্ষতিকর, পশ্চিমবাংলার জন্য ক্ষতিকর, সকলের জন্যই ক্ষতিকর। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতির কথা তিনি বলেছেন, সেটা এরকম– নদীর পানি নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে দেন-দরবার করছি। আমার কতটুকু পানি দরকার, ইঞ্জিনিয়াররা যেটা নির্ধারণ করে, তা ভাসানী মানেননি।
ভাসানীর ভাষ্য ছিল, তুমি পানির পরিমাণ নিয়ে তর্কবিতর্ক করতেই পারো, কিন্তু একটা কথা বুঝিয়ে বলো তো, এই সাপের যে পানি লাগবে, ব্যাঙের যে পানি লাগবে, মাছের যে পানি লাগবে, তার মাপজোখ কে করবে? আরও কত জীব-অনুজীব, গাছপালার যে পানি লাগবে, সেটার হিসাব কী করে করবা? এটার হিসাব তো তুমি দিতে পারবা না। তুমি তো ব্যাটা ইঞ্জিনিয়ার, পানিকে কেবল পানি আকারে দেখতেছ। কিন্তু কৃষকের কাছে পানি তো শুধু পানি না, এটা তো কৃষির উপাদান, কৃষির ভিত্তি। প্রাণের ভিত্তি, প্রাণের আশ্রয়। বাংলাদেশটা নদীপ্রধান, নদীমাতৃক দেশ। তিনটা নদী এখানে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের নেপাল থেকে পলিমাটি আসছে। এই মাটিও তো আমাদের না। এই মাটিও তো হিমালয়ের মাটি। এখানে পলিমাটিকে কেন্দ্র করে একটা উর্বর ভূমি গড়ে উঠেছে।
হিমালয় থেকে পানি নেমে আসছে। সেই পানি থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, প্রাণ-প্রকৃতি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠছে। একটা অত্যন্ত উচ্চ-সভ্যতা গড়ে উঠছে। এই সভ্যতাকে যদি আমরা সুরক্ষা দিতে চাই, নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই ফারাক্কা ভেঙে দিতে হবে। এটা আমাদের সকলের জন্য ক্ষতির কারণ, আমাদের জন্য যেমন, ভারতের জনগণের জন্যও তেমন। পশ্চিমবাংলার জনগণের জন্য এটাই হবে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রকৃতি যেভাবে আমাদেরকে প্রাণ দান করে, প্রকৃতিকে যেভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, এই শক্তিটাকে যদি আমরা ঠিকভাবে ভজনা করতে না পারি, ঠিকভাবে বুঝতে না পারি, ঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারি– আমরা কিন্তু প্রজাতি হিসেবে ধ্বংস হয়ে যাব।
সামনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন আসছে। এই দিনে মওলানা ভাসানীকে আমি স্মরণ করি। আসলে তাঁকে আমি প্রতিদিনই স্মরণ করি। প্রতিদিন ভোরবেলা ভাসানীর নামটা নিয়ে আমি উঠি। এত বড় চিন্তাবিদ, এতবড় গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক, যার কাছে আমরা গণঅভ্যুত্থান শিখেছি, জনগণকে কীভাবে সংগঠিত করতে হয়, তা শিখেছি। তিনি আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবেন।
১০ ডিসেম্বর ২০২৪। শ্যামলী।