উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ
উত্তরউপনিবেশবাদ বলতে চিন্তা ও বিশ্লেষণের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গী বোঝায় যার মূলে রয়েছে এই বিশ্বাস যে ঔপনিবেশিক জামানার প্রভাব বাদ দিয়ে বর্তমান জামানার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী অবধি বিশ্বের বহু দেশ ইয়োরোপীয় নিয়ন্ত্রণে পরাধীন জাতি হিসাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘ কালব্যাপী পরাধীন অস্তিত্ব সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা এবং মননশীলতার অভিমুখের ওপর প্রগাঢ় ছাপ রেখেছে এবং পরাধীনতার অবসানেও এই ছাপ অব্যাহত রয়েছে। উত্তরউপনিবেশবাদ এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে পরাধীনতামুক্ত জাতিগুলোর বর্তমান গতিপ্রকৃতির অন্যতম কার্যকারণ সূত্র হিসাবে গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে।[১]
এটি উপনিবশি শাসন, শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার কারণে উপনিবেশিত জনগণের মানসিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ তাবৎ জ্ঞানকাণ্ডে যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে তা চিহ্নিত ও নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যে উদ্ভুত সাংস্কৃতিক-সামাজিক দর্শণ ও আন্দোলন। উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলমের মতে, ”উপনিবেশী শাসকদের উদ্যোগে-সমর্থনে পরিচালিত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার কারণে উপনিবেশিত দেশ ও জাতির ঐতিহ্য- অভিজ্ঞতা, ভাবনার জগত ও তার চর্চার ক্ষেত্রে যেসব নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে সেগুলো চিহ্নিত ও দূর করা এবং আধিপত্যমুক্ত জ্ঞানচর্চার পথ খূলে দেয়ার কিছু তাত্ত্বিক প্রণোদনা ও উপায় এবং একরকম আন্দোলন বলা যেতে পারে উত্তরউপনিবেশবাদকে। চরিত্রের দিক থেকে এটি একটি পাল্টা জ্ঞানভাষ্য।”[২] উপেনিবেশায়নের নেতিবাচক সাংস্কৃতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ থেকে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[৩] জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চা থেকে উপনিবেশিকতা বিদূরিত করে আত্মপরিচয় অর্জন করার কথা এ-দর্শন বলে থাকে। এর বক্তব্য হলো প্রাক-উপনিবেশী অতীতের গৌরবোজ্জ্বল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্জনগুলো সনাক্ত করে সেগুলোকে যথাযথ মর্যাদায় পুনর্মূল্যায়িত করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে জাতির বিকাশের গতিপথ। তবে রবার্ট ইয়ূং-এর মত উত্তরউপনিবেশী তাত্ত্বিকরা সতর্ক করেন যে, যে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিবেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তাকে পটভূমি হিসাবে বিবেচনায় রেখেই উপনিবেশায়নের নেতিবাচক প্রভাব নির্ধারণ করতে হবে।[৪]
আধুনিকতার প্রতি উত্তরউপনিবেশবাদীদের বিরোধিতা বহুলাংশে ইতিবাচক। কারণ তাদের বক্তব্যে আধুনিকতার প্রতি চরম বিদ্বেষ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার চিহ্ন ও সুযোগ পরিলক্ষিত হয় না, যৌক্তিক শৃঙ্খলা, স্তরবিন্যাস, কাঠামো, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ভেঙে ফেলার বাসনা নেই, রয়েছে উপনিবেশবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির ‘কেন্দ্র-প্রান্ত’ জাতীয় বিন্যাস ভাঙার উদ্দেশ্য। তবে আধুনিকতাবাদীদের দু:খ, ক্ষয়, জীবনের প্রতি বিবমিষা, সর্বগ্রাসী হতাশা ও অর্থহীনতার বোধ থেকে উত্তর-উপনিবেশবাদীরা মুক্ত। তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে ইতিবাচক ও আশাবাদী। উপনিবেশি শাসনপুষ্ট শিহ্মাব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার কারণে একশ্রেণীর মানুষের দ্বারা অন্যশ্রেণীর মানুষদের উপর যে-শোষণ চালিত হয়, তা দূর করার প্রণোদনাও উত্তর উপনিবেশবাদে রয়েছে।
১৯৭৮ সালে ফিলিস্তিনী বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের “অরিয়েন্টালিজম” গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর উত্তরউপনিবেশবাদ নিয়ে আলোচনা সামালোচনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।এর সাথে যুক্ত হয় ইব্রাহিম ফ্রান্ৎজ ফানোর ”ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক” ও “রেচেড অব দি আর্থ” বই দুটোয় উপনিবেশিত মানুষের উপর উপনিবেশী শাসনের নেতিবাচক প্রভাবের দুর্দান্ত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এর আগে বিষয়টি ছিলো শুধুই রাজিনৈতিক স্বাধীনতা/পরাধীনতা বিষয়ক আলোচনায় সীমাবদ্ধ। সাঈদ তার বইয়ে বিশ্লেষণ করে দেখান কীভাবে পশ্চিমের রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কয়েকশ বছর ধরে বিভিন্ন গ্রন্থাদি লিখে প্রাচ্যকে সকল দিক থেকে হীন এবং পশ্চিমকে উন্নত বলে প্রচার করেছে। এক পর্যায়ে পশ্চিমের মানুষ তা বিশ্বাসও করে। পরে প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রাচ্য সম্পর্কিত এই হীন ধারণা প্রাচ্যের মানুষদের মনেই গেঁথে দেয়া হয় উপনিবেশী শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। এইসব উপনিবেশী প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দেশজ ঐতিহ্য, নিজস্ব জ্ঞান এবং ঐতিহাসিক অর্জন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেদের নতুনভাবে গড়ে নিতে চান উত্তরউপনিবেশবাদীরা।
এডওয়ার্ড সাঈদের “অরিয়েন্টলিজম” এবং ফানোর “ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক” ও “রেচেড অব দি আর্থ” উত্তরউপনিবেশবাদের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান কয়েকজন উত্তরউপনিবেশী তাত্ত্বিক হলেন: নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা (১৯৩৮- ), গ্র্রায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিবাক (১৯৪২- ), হোমি কে, ভাবা (১৯৪৯- ), রবার্ট জে সি ইয়ুঙ (১৯৫০- ), বিল এ্যাশক্রফট্ (১৯৫২- ) প্রমুখ।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Postcolonial Theory লেখক J Daniel Elam
- ↑ আলম, ফয়েজ (২০০৬)। উত্তর-উপনিবেশী মন। ঢাকা: সংবেদ প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ১১। আইএসবিএন 984 32 3329 8।
- ↑ see, Ashcroft, Bill, Griffith, Gareth, and Tiffin, Helen , (২০০০)। Post Colonial Studies, The Key Concepts, 2nd Edition। London and New York,: Routledge,। পৃষ্ঠা p–168।
- ↑ Young, Robert (২০০১)। Post Colonialism: An Historical Introduction। Oxford UK.: Blackwell Publishers। পৃষ্ঠা page–165।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- Postcolonial & Transnational Theories
- Communitarian Agonism ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ মে ২০১২ তারিখে Project for a postcolonial Nietzsche
- Postcolonial Islam
- Contemporary Postcolonial and Postimperial Literature
- A special issue of the journal Labyrinthe. Atelier interdisciplinaire, 2006 (in French): "Faut-il être postcolonial ?"
- Paper about Post-Colonialism: Definition, Development and Examples from India
- Pakistaniaat: A Journal of Pakistan Studies
- The Postcolonial Space
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |