Drafts by Md. Monirul Islam
আধুনিকতা যেভাবে গোটা দুনিয়ার মুক্তিদায়ী প্রকল্পরূপে হাজির হয়, মিগনোলো তাতে বাদ সেধেছেন। আধুনিকতার... more আধুনিকতা যেভাবে গোটা দুনিয়ার মুক্তিদায়ী প্রকল্পরূপে হাজির হয়, মিগনোলো তাতে বাদ সেধেছেন। আধুনিকতার তিনি একজন কট্টর সমালোচক। একে তিনি উপনিবেশিকতার অলংকৃতি রূপে বোঝেন। তার চিন্তায়, আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতা একে অপরের পরিপূরক। উপনিবেশিকতা ছাড়া যেমন আধুনিকতা সম্ভব নয়, তেমনই আধুনিকতা ব্যতীতও উপনিবেশিকতা অকল্পনীয়। তারা একে অপরের গাঠনিক শর্ত—উপজাত নয়। এইভাবে বোঝার ক্ষেত্রে, মিগনোলোর পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন পেরুর সমাজতাত্ত্বিক আনিবাল কিহানো। উপনিবেশিকতা পরিভাষাটির তিনিই প্রবর্তক। কিহানো একে উপনিবেশবাদ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বোঝেন। এই উপনিবেশিকতাই রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত উপনিবেশবাদকে বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রাখে। উপনিবেশিকতা ক্ষমতার উপনিবেশিকতার সংক্ষিপ্ত রূপ। ক্ষমতার উপনিবেশিকতা ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাকে নির্দেশ করে। যে মাতৃকার অন্তর্গত আমরা সকলেই। মিগনোলোর মতে, এর কোনো বাহির নেই। এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে এর অন্তর্গত থেকেই তা করতে হবে। যে অবস্থানটিকে তিনি প্রান্তীয় বলে পেশ করেন। প্রান্তীয় চিন্তনের লক্ষ্য হলো ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাকে ছেদ করে বেরিয়ে আসা। মিগনোলো যাকে বলবেন—বিযুক্তকরণ। বিযুক্তকরণের এই করণ নানাভাবে সাধিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও এর জ্ঞানতাত্ত্বিক চরিত্রটাই প্রধান হয়ে ওঠে। কিহানো যেমন জোর দিয়েছেন জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের ওপর। মিগনোলো জোরারোপ করেন উপনিবেশিকতা থেকে বিযুক্তকরণকে। একেই তিনি বিউপনিবেশিকতা বলে দাখিল করেন। তার মতে, এই বিউপনিবেশিকতা আর বি-উপনিবেশায়ন একই ঘটনা নয়। এর বিস্তারিত আলাপ এই প্রবন্ধে পাওয়া যাবে ।
বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পান... more বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণার্থে প্রতিষ্ঠা করা হলেও কলেজটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আধুনিক বৈশিষ্ট্যের প্রবর্তন ও বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রূপান্তরে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। যে সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশরা বাংলা অঞ্চলে জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়ন ঘটায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জটিল ভূমিকা ও ভারতবর্ষের ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের কারণে এর ক্ষমতা-প্রকরণ নির্ণয় করা সহজ ছিলো না। যে-কারণে, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকবৃন্দ কলেজটিকে কেন্দ্র করে যে-ধরনের জ্ঞানোৎপাদন করেছেন তা চিন্তার ঔপনিবেশিক কাঠামোটিকে ছেদ করতে পারেনি। ফলে, বরাবর তা ইউরোকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তেই পর্যবসিত হয়েছে, অথবা তার সরল নেতিকরণ হয়েছে মাত্র। যার দরুন প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃক সৃষ্ট উপনিবেশিকতা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। উপনিবেশিকতা রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশবাদের পতনের পরেও জ্ঞানতত্ত্বে তাকে টিকিয়ে রাখে। চিন্তা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের ধরণ ও ভাষা-প্রকৌশল উপনিবেশিতই থেকে যাবার কারণে ক্ষমতার ঔপনিবেশিক মাতৃকাটি উপনিবেশবাদের পরিসমাপ্তির পরেও অক্ষতই রয়ে যায়। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক চোরাবালি থেকে বেরোবার জন্য প্রয়োজন চিন্তার নতুন কাঠামোর প্রবর্তন, আলোচনার নতুন মাপকাঠি ও পরিভাষা নির্মাণ যা--উপনিবেশায়নের ফলস্বরূপ সৃষ্ট উপনিবেশিকতা নস্যাৎ করে--নতুন জ্ঞানতত্ত্ব সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখবে। বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন ও লাতিন আমেরিকার বিউপনিবেশিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সম্পর্কিত চিন্তার কাঠামো পরিবর্তনই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
এলিফ শাফাকের ‘ফোর্টি রুলস অফ লাভ’ উপন্যাসে শামস-ই তাবরিজের চল্লিশটি উপলব্ধির উল্লেখ আছে। ইন্টারনে... more এলিফ শাফাকের ‘ফোর্টি রুলস অফ লাভ’ উপন্যাসে শামস-ই তাবরিজের চল্লিশটি উপলব্ধির উল্লেখ আছে। ইন্টারনেটে সেগুলো একত্রে পাওয়া যায়। এক, দুই, তিন করে চল্লিশ পর্যন্ত। কথাগুলো সুন্দর ও তাৎপর্যবহুল। উৎসের সত্যাসত্য যাচাই না করে সেগুলো নিজের জন্য অনুবাদ করি। নিজের জন্য মানে নাদিম ভাইয়ের জন্য। আমাদের 'নিজ' আসলে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে। উপলব্ধিগুলোকে ইদানিং আমার কাছে একেকটা উপপাদ্যের মতো লাগে। যার একটির সঙ্গে আরেকটির গভীর যোগ।
আমি নাম দিয়েছি 'করুণার চল্লিশ সূত্র'। অনুবাদ যথার্থ হলো কিনা এখনও ভাবছি।
‘তাও তে চিং’ (Tao Te Ching) খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৫০০ বছর আগের রচনা। ধর্মীয় তাওবাদী ধারা বিশ্... more ‘তাও তে চিং’ (Tao Te Ching) খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৫০০ বছর আগের রচনা। ধর্মীয় তাওবাদী ধারা বিশ্বাস করে যে, ‘তাও তে চিং’-এর রচয়িতা একজনই। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতরা এই কথা মানেন না। তাদের মতে তাও তে চিং-এ অনেকেরই রচনা আছে। বিশেষ করে লাও ৎজু নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি ‘তাও তে চিং’ লিখেছেন, তার কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। কারণ⸺লাও ৎজু, লি আড় বা লাও তান যে নামের কথাই হোক না কেন ‘তাও তে চিং’-এর সঙ্গে তা পরে সম্পর্কিত হয়েছে। ‘তাও তে চিং’-এর সঙ্গে লাও ৎজুর নাম যখন প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হলো, তখনও লাও ৎজুর কথিত জীবনের থেকে তা পেরিয়ে গেছে হাজার বছর। এমনকি, তাও তে চিং-এর প্রাচীনতম সংস্করণটিতেও লাও ৎজু বা লি আড়ের নাম নেই। বরং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘তাও এবং তে সম্পর্কিত পুস্তক’টির শিরোনাম ছিলো লাও ৎজু, যার মূলগত অর্থ দাঁড়ায়, সেই বুড়ো শিক্ষকের প্রজ্ঞা। যে অর্থ সুনির্দিষ্টভাবে কারো নাম আসলে প্রস্তাব করে না। তাছাড়া, চিনা ঐতিহ্যে রচয়িতার কর্তৃত্বারোপ হয়ে থাকে প্রতীকী অর্থে, মোটেই ঐতিহাসিক অর্থে নয়। এ-সকল কারণেই, আধুনিক পণ্ডিতেরা তাও তে চিং-কে, মৌখিকভাবে বিন্যস্ত, বহু রচয়িতার রচনার একটি সংকলন বলেই ধারণা করেন।
‘তাও তে চিং’-এর এখানে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। ভাবকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা। অবলম্বন করা হয়েছে, ক্যারোল দিপ্পি অনূদিত তাও তো চিং-এর ইংরেজি অনুবাদ। এছাড়া তাও তে চিং-এর রুশ সংস্করণ থেকে ইংরেজিতে অনূদিত একটি সংস্করণও ব্যবহৃত হয়েছে। চোখ বুলানো হয়েছে অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদগুলোতেও। (অনুবাদটি খোরশেদ আলম সম্পাদিত ‘শিশিরের শব্দ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিনে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।)
বাংলাদেশের সাহিত্য ৫০ বছরে পা দিয়েছে। ৫০ বছর কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে এর নিজস্ব রূপ ও স্বর গড়ে ও... more বাংলাদেশের সাহিত্য ৫০ বছরে পা দিয়েছে। ৫০ বছর কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে এর নিজস্ব রূপ ও স্বর গড়ে ওঠার কথা। হয়তো তা উঠেছেও, অথবা উঠছে। তা না-হওয়ার তো কারণ দেখি না। বাংলাদেশের সাহিত্যের বয়স যদিও পঞ্চাশ হলো এর লিগ্যাসি কিন্তু পঞ্চাশ বছরের নয়। কেউ বলবেন হাজার বছরের কথা। কেউ হয়তো আপত্তি করবেন সেই কথায়। কারণ, যে সাহিত্যকে আমরা চিনি তার তো জন্ম হয়েছে উনিশ শতকের কলকাতায়। তাহলে, হাজার বছরের প্রসঙ্গ আসে কেন! আর এই যে পঞ্চাশ বছর ধরে - স্বাধীন বাংলাদেশের জমিনে - আমরা সাহিত্যটাহিত্য করছি এর ফল কী হলো! প্রশ্নটাকে এইভাবেও উত্থাপন করা যায়, জনজীবনে সাহিত্যের ভূমিকাটা আসলে কী! ‘সাহিত্য’, এই নাম-পরিচয় নিয়েও কিন্তু তর্কের শেষ নেই। তাছাড়া, সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও চালু আছে বিস্তারিত তর্ক। বাংলাদেশের সাহিত্যের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই এলোপাতাড়ি বিতর্কগুলো উসকে দেয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য। বর্তমান জমানায় সাহিত্য যে আর অবিসংবাদী ভূমিকায় নেই, খোঁচা দিয়ে হলেও, বাংলাদেশের সাহিত্যকে তা তো মনে করিয়ে দিতে হবে। প্রবন্ধটি সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘সহজিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিলো।
শামস-ই তাবরিজের সান্নিধ্যে আসার আগে জালালুদ্দিন রুমি একজন বিদ্বান হিসেবে জীবনযাপন করতেন। পড়াতেন, ... more শামস-ই তাবরিজের সান্নিধ্যে আসার আগে জালালুদ্দিন রুমি একজন বিদ্বান হিসেবে জীবনযাপন করতেন। পড়াতেন, ধ্যান করতেন, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। শামসের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ঘটনাটি নানাকারণে ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। প্রথম সাক্ষাতে জ্ঞানগরিমায় পূর্ণ রুমিকে শামস একটি প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিলো, কে বড়ো মুহাম্মদ (সা.) না বোস্তামি, যেখানে বোস্তামি খোদাকে পেয়ে তৃপ্ত, আর মুহাম্মদের (সা.) যেন অতৃপ্তির শেষ নেই? রুমি আকাঙ্ক্ষিত জবাবটিই দিয়েছিলেন। এভাবেই শুরু। ক্রমেই তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। তাদের এই বন্ধুত্ব তাদের উভয়ের জন্য তো বটেই, গোটা জগতের জন্যই ছিলো খোদার আশীর্বাদস্বরূপ। সম্পর্কের এক-পর্যায়ে রুমি তার শামসকে হারিয়ে ফেলেন। প্রথমবার হারানোর পর অনেক কষ্টে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেলেও দ্বিতীয়বার তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। শামসকে না-পেয়ে কাতর হয়ে পড়েছিলেন রুমি। শামসের বিরহে হয়ে ওঠেছিলেন পাগলপারা। আর অন্বেষণের মধ্য দিয়েই তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন, যাকে তিনি অবিরাম খুঁজে চলেছেন সে বিরাজ করছে তার সমগ্র সত্তাজুড়েই। কবিতাগুলো কোলমান বার্কসের ‘The Essential Rumi’ বইটি থেকে অনূদিত হয়েছে।
জফির সেতুর উপন্যাস ‘একটা জাদুর হাড়’-এ (২০২০) জীবন এক কেন্দ্রীয় বিষয়। তার অনুষঙ্গগুলো হাতড়ে হাতড়ে ... more জফির সেতুর উপন্যাস ‘একটা জাদুর হাড়’-এ (২০২০) জীবন এক কেন্দ্রীয় বিষয়। তার অনুষঙ্গগুলো হাতড়ে হাতড়ে আখ্যানের পাত্র-পাত্রীরা বারবার মুখোমুখি হয়েছে স্থির ও বিষয়গত এই আস্ত জীবনের। ভ্রু কুঁচকে তারা তাকিয়েছে সেই জীবনের পানে। প্রিজমের মতো যা বিকীর্ণ করেছে রঙের বিভ্রম। তারা মন্তব্য ছুঁড়েছে মুহুর্মুহু। বিষয়ীর দেমাগ নিয়ে অধিকার করতে গিয়েছে তাকে। হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। জীবনকে তারা পায়নি। কেননা, বিষয়ী ও বিষয়ের ভেদসূত্রে তা বরাবর অধরা! বরং জীবনকে অধিকার করার যে বাসনা, ধ্বনিত হয়েছে গোটা উপন্যাস জুড়ে, আদতে তা ঘোষণা করেছে উপনিবেশিত যাপনের কথা। বিষয়ী ও বিষয়ের ভেদ, বৈজ্ঞানিক যৌনলিপ্সা, নারীর বিষয়করণ ও বিষয়গত এক আস্ত জীবনের নির্মাণ উপনিবেশিত যাপনের বৈশিষ্ট্যসূচক। গ্রামের ছেলে বিজয় তাই এক উপনিবেশিত চরিত্র। বিচ্ছিন্ন ও আগন্তুক। বিজয় উপন্যাসের কথক চরিত্রটির নাম। তার জবানেই আমরা শুনতে পাই পুরো গল্প। ‘বিজয়’⸺কী আধিপত্যশীল একটি নাম! কাকে জয় করবে সে! জীবনকে! নাকি মিথুনকে! মিথুন উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই পাক খেয়ে গেছে বিজয়ের জীবনের পরিধি। তাকে আশ্রয় করেই কর্তারূপে নিজের প্রতিষ্ঠা দেখেছে বিজয়। ‘মিথুন’ শব্দের আভিধানিক একটি অর্থ⸺স্ত্রী-পুরুষের মিলন; যৌন মিলন। বিজয়ের কাছে যোনিই কি হয়ে উঠেছিলো জীবনের প্রবেশদ্বার! প্রধান দুটি চরিত্রের বিজয় ও মিথুন নামকরণের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক কি অর্থগত এই অনুরণনটাই সৃষ্টি করতে চেয়েছেন! স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন জীবনকে দেখার পুরুষতান্ত্রিক রকম! বর্তমান প্রবন্ধে এই পুরুষতান্ত্রিকতাকেই আমরা পাঠ করেছি আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতার সঙ্গে মিলিয়ে। (প্রবন্ধটি সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘সহজিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না!’⸺খুব সুন্দর করে বলেন কবি। আ... more ‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/ সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না!’⸺খুব সুন্দর করে বলেন কবি। আর এটা বলার মধ্য দিয়ে আল মাহমুদ আরেকটি কাজ করেন। তা হলো⸺কবিতাকে করে তোলেন নির্দিষ্ট। ‘ফিক্সড।’ ‘কবিতা’ বলতে তাঁর কথায় নির্দেশিত হয় সুনির্দিষ্ট একটা কিছু যা ‘ও পাড়ার রোজেনা’ বুঝতে অপারগ। কবিতা এখানে ‘এমন একটা কিছু’ হয়ে ওঠে যাকে বোঝা যায়, অথবা যায় না। আমার খুব জোরোলো সন্দেহ⸺কবিতা বলতে আল মাহমুদ এখানে আধুনিক কবিতাই বুঝিয়েছেন। আরও সুনির্দিষ্ট অর্থে, যে কবিতা ইউরোপীয় আদর্শে গড়া। আসলে কোনো এক-প্রকার অর্থকে ‘ফিক্সড’ করে তোলার একটা বড় অসুবিধা হলো, বাকি প্রকারগুলোকে সে ‘দূর! দূর!’ করে প্রান্তে তাড়িয়ে দেয়। সেগুলো আর কেন্দ্রে ফেরার সাহস পায় না। ফিরতেও দেওয়া হয় না। তাই, বর্তমান আলোচনায় চেষ্টা করেছি কবিতাকে তার কোনো প্রকার অর্থ ও গরিমাতেই নির্দিষ্ট না-করার। নইলে হিমেল বরকতের কবিতা পড়তে গেলে বিপদে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এখানে ‘দশমাতৃক দৃশ্যাবলি’ (২০১৪) কাব্যটাকে আমি চেষ্টা করেছি নিজের মতন করে পড়ার। যেখানে দেরিদার চিন্তা আমাকে ভালো মতোই প্রভাবিত করেছে। আর, পড়তে গিয়ে যে কথাটি বারবার খোঁচা দিয়েছে⸺একটি কাব্য পাঠ করার সময় পাঠক আসলে কতোটা পরাধীন! কেননা, কাব্যপাঠের প্রচলিত ধরন বারবার তাকে চোখ রাঙায়। মাথা নেড়ে বলতে থাকে⸺‘হোলো না। হোলো না।’ আরেকটি কথা বলা দরকার, হিমেল বরকতের কাব্যের মূল্যায়ণ হিসেবে লেখাটাকে পাঠ করা একদম উচিৎ কাজ হবে না। এটি একটি পাঠ মাত্র। দশটি পাঠের একটি পাঠ। (প্রবন্ধটি সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘সহজিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
কিহানো লক্ষ করেছেন যে আমেরিকা দখলের আগেকার আমলের উপনিবেশবাদ কোনো বৈশ্বিক শক্তির ভিত্তিপ্রস্তরস্বর... more কিহানো লক্ষ করেছেন যে আমেরিকা দখলের আগেকার আমলের উপনিবেশবাদ কোনো বৈশ্বিক শক্তির ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ ছিলো না। সেইক্ষেত্রে, আমেরিকার উপনিবেশায়ন ছিলো ব্যতিক্রম⸺তা নির্মাণ করেছে নতুন ধরনের এক ক্ষমতা কাঠামো। এবং বিশেষ এই ক্ষমতাসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনে পৃথিবীর মানুষ সংজ্ঞায়িত হয়েছে বর্ণবাদী মানদণ্ডে; ‘পুঁজিবাদ’ শিরোনামে পুনর্বিন্যাসিত হয়েছে গোটা দুনিয়ার শ্রমপরিসর; জ্ঞানোৎপাদনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বিষয়ী-বিষয় নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ, গড়ে উঠেছে উপনিবেশিকতা। তিনি এর নাম দেন⸺ক্ষমতার উপনিবেশিকতা। ক্ষমতার উপনিবেশিকতায় ইউরোকেন্দ্রিক যুক্তির আশ্রয়ে গড়ে ওঠে বিশেষ কিসিমের যৌক্তিকতাও যা আপনকার প্রাদেশিক ও উপনিবেশিক চরিত্র গোপন করে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার ঝান্ডা উড়িয়ে হাজির হয়েছে সর্বজনীন রূপে। ইউরোপীয় ভূখণ্ডের অভিজ্ঞতা ও ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বে উৎপাদিত জ্ঞান যেখানে পেশ করা হয়েছে গোটা পৃথিবীর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বলে। যার দরুন, ইউরোকেন্দ্রিক জ্ঞানতত্ত্ব হয়ে ওঠেছে এক ও অদ্বিতীয়। যেই জ্ঞানতত্ত্বের অন্তর্গত উপনিবেশিকতা আড়াল হয়েছে আধুনিকতার বয়ান দিয়ে। কিহানোর এই সূত্র ধরেই কিহানো-প্রভাবিত লাতিন আমেরিকার অপরাপর তাত্ত্বিকেরা আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতাকে প্রতিপন্ন করেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গঠনগতভাবেই যার একটি অপরটিকে আড়াল করে রাখে । তাদের ভাবনায় আধুনিকতা উপনিবেশিকতারই নামান্তর। মাঝখানে স্ল্যাশ ব্যবহার করে এই দুইটিকে তারা বিজড়িত করে তোলেন। লেখেন⸺আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা। গড়ে তোলেন ‘আধুনিকতা/ উপনিবেশিকতা গবেষণা প্রকল্প’। কিহানো এই উপনিবেশিকতাকে নস্যাৎ করতে বি-উপনিবেশায়ন হিসেবে প্রস্তাব করেন জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠন, যা ইউরোপীয় সর্বজনীনতার দাবির পরিবর্তে প্রস্তাব করে কতিপয় সর্বজনীনতা, যা ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের জবরদস্তির ফলে চাপা-পড়া অপরাপর জ্ঞানতত্ত্বের আবির্ভাবকে স্বাগত জানায়; ইউরোকেন্দ্রিক যৌক্তিকতা নয়⸺যা প্রস্তাব করে ভিন্ন ধরনের যৌক্তিকতা।
দীর্ঘ সময় ধরে, প্রায় এক বছরেরও বেশি সময়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার নানারকম ফল হওয়ার কথা। তার স... more দীর্ঘ সময় ধরে, প্রায় এক বছরেরও বেশি সময়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার নানারকম ফল হওয়ার কথা। তার সবগুলোই যে আবার অল্প সময়ের ব্যবধানেই স্পষ্ট হবে, তা আশা করাটাও সমীচীন নয়; কিছু দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব তো থাকবেই। আর বন্ধ থাকার কারণটি যেখানে ভয়ঙ্কর মহামারি ঘটিত সেখানে অন্য আরও মাত্রা এসে যোগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঘটনাটি শুরুতে এক-রকম উপভোগ্যই ছিলো। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই। ধীরেই ধীরেই তা বিভিন্ন সংকটের উৎস হয়ে উঠেছে। এখানে অবশ্য একটা বিষয়ে পরিষ্কার হওয়ার দরকার আছে: এই রকম পরিস্থিতিতে কোনো সংকটই আসলে পরস্পর সম্পর্ক বিবর্জিত নয়। দেখা যাবে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সংকটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে একদম ভিন্ন আরেক সমস্যা; যা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষা সম্বন্ধীয়ই নয়। ফলে, ঘটনা এক্ষেত্রে সরলরৈখিক থাকেনি, অনেকটাই তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। সংকটের উৎস হয়ে উঠেছে এক-ধরনের মাতৃকা (matrix)। তারপরও পরস্পর বিজড়িত সমস্যাকে পৃথক করে বর্ণনা করার উপায় আমাদের চালু ভাষা-কাঠামোর মধ্যে অন্তত রয়েছে। এটা সুবিধারই কথা। বর্তমান নিবন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকার ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে ভিন্নভাবে বোঝা ও উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক নয়, এক্ষেত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেই আলোচনাটা করা।
(লেখাটি 'SUSTAIN BD Education & Development Review'-এ ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো)
জসীম উদদীন বাংলার মাটি ও মানুষের কবি। তাঁর কবি পরিচয়ের আড়ালে লুক্কায়িত রয়েছে আরেকটি পরিচয়। তিনি এ... more জসীম উদদীন বাংলার মাটি ও মানুষের কবি। তাঁর কবি পরিচয়ের আড়ালে লুক্কায়িত রয়েছে আরেকটি পরিচয়। তিনি একজন শক্তিশালী গদ্যশিল্পীও বটে। তাঁর রচিত স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি ও প্রবন্ধসমূহে সরস গদ্যের নিদর্শন মেলে। এই সকল রচনায় জসীম উদদীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক সংকট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি একযোগে পর্যালোচনা করেছেন : বাঙালি সংস্কৃতিতে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাব, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং বাঙালি মুসলমানের আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে। বর্তমান উপনিবেশোত্তর পর্বে, নব্য উপনিবেশবাদ মোকাবিলার এই যুগে, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধী প্রবর্তনার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রবন্ধে জসীম উদদীনের স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধসমূহের আলোকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বিপরীতে তাঁর যে প্রতিরোধের 'প্রতিষ্ঠাভূমি' গড়ে ওঠে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জসীম উদদীনের তৎপরতাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বের তাত্ত্বিকদের ভাবনা ও তাঁদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অভিধার প্রয়োগ সমন্বিত করা হয়েছে।
দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি এদেশীয় শিক্ষিত লোকদের কোনো প্রকার আগ্রহ ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঔপ... more দেশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি এদেশীয় শিক্ষিত লোকদের কোনো প্রকার আগ্রহ ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিকেই প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করার প্রচলন ছিল। তাই ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ যখন প্রাচ্যচর্চার সুবাদে সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষার প্রাচীন পুথি আবিষ্কারে ব্রতী হলেন তখন দেশীয় পণ্ডিতবর্গ নিজ সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হওয়ার প্রস্তুত ক্ষেত্র পেলেন। এই সুযোগে মৌখিক সাহিত্যের নিদর্শন সংগ্রহ, প্রাচীন পুথি আবিষ্কার ও সম্পাদনায় জোয়ার আসে। এই কর্মযজ্ঞ পুরোপুরি ইউরোপীয়দের নির্দেশিত পথে হয়নি। বরং দেশীয় পণ্ডিতেরা এর দ্বারাই প্রস্তুত করেছেন জাতীয়তাবাদের ভিত। ফলে গল্পগুলো কৃষক-তাঁতি-জেলে-কাঠুরেদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের প্রকাশ হিসেবে পর্যালোচনার সুযোগ নষ্ট হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বাংলা লোকগল্প চর্চার এই জটিল পরিপ্রেক্ষিত।
‘প্রবলেম’(Problem) শব্দটি আমাদের পূর্বপরিচিত। বাংলা একাডেমি ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিতে (Bangla Academ... more ‘প্রবলেম’(Problem) শব্দটি আমাদের পূর্বপরিচিত। বাংলা একাডেমি ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিতে (Bangla Academy English-Bangla Dictionary) এর অর্থ নির্দেশ করা আছে : সমস্যা; জটিলপ্রশ্ন। প্রবলেম বলতে আমরা বুঝি সমস্যা। প্রশ্ন বা জটিলপ্রশ্ন বুঝি না। ইংরেজিতে ‘Question’ বলতে ঠিক যা বোঝায় - সেই অর্থে আমরা ‘প্রশ্ন’ বা ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দগুলো বুঝি। আবার যে বা যা-কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে - অভিধানের তোয়াক্কা না করে - তাকে আমরা নিজেরাই বলি ‘প্রবলেম্যাটিক’ (Problematic)। অভিধানে ‘প্রবলেম্যাটিক’ মানে - অনিশ্চিত; সমস্যাসংকুল; সংশয়িত। শব্দটিকে আমরা একপ্রকার বাংলা শব্দেই পরিণত করে ফেলেছি। ফলে বর্তমান আলোচনায় উপর্যুক্ত পূর্বধারণাসমূহ আমাদের একটু বিপদেই ফেলবে। অন্তত প্রবলেম্যাটিক সম্পর্কিত কথাবার্তাগুলো বোঝা মুশকিল হয়ে যাবে। পূর্বে শব্দটিকে আমরা বিশেষ্য অর্থে প্রয়োগ করতাম না। করতাম বিশেষণার্থে। ‘প্রবলেম’ হল বিশেষ্য - আর তার বিশেষণ হিসেবে ‘প্রবলেম্যাটিক’। অথচ বর্তমান আলোচনায় দুইয়ের কোনোটিই নয়, তত্ত্বদুনিয়ায় ব্যবহৃত, বিশেষ ধারণার্থে ‘প্রবলেম্যাটিক’ শব্দটি ব্যাখ্যাত হবে। অর্থাৎ, আমাদের অতিপরিচিত অভিধান-নির্দেশিত অর্থে নয়। দেশি অর্থেও নয় - আমূল বিদেশি অর্থে।
(বর্তমান আলোচনাটি শিল্প-সাহিত্যের ওয়েব ম্যাগ ‘‘শিশিরের শব্দ’’-এ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দেখছিলাম - করোনা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণোপলক্ষে - মানুষের ঘরের বাহির হ... more সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে দেখছিলাম - করোনা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণোপলক্ষে - মানুষের ঘরের বাহির হওয়া বারণ। এবং যারা বেরোচ্ছে তাদের ধরে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে পুলিশ। কারণ, যারা বেরোচ্ছে তারা ‘নিজ’-এ ভাইরাসাক্রান্ত হতে পারে। এবং সেই ভাইরাস তারা ছড়িয়ে দিতে পারে ‘পর’-এর মধ্যে। পরের সঙ্গে ‘নিজ’-এর এমন প্রত্যক্ষ ও গভীর যোগাযোগ, ইতিহাসে এর-আগে, মানুষ কখনো উপলব্ধি করেছিল কিনা! এই জিজ্ঞাসা তীর্যক হলেও এর কার্যকারিতা, নিঃসন্দেহে বহুমাত্রিক। ব্যক্তিসর্বস্ব এই পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থায় পরকে বাঁচানোর এমন বেদম আগ্রহ কম স্ববিরোধী নয়। কেননা, পরকে ধ্বংস করার শর্তেই এই ব্যবস্থা টিকে থাকে। ফলে, বুর্জোয়া সংস্কৃতির এমন নাজেহাল দশায় ‘আত্ম’কে রক্ষা করতে গিয়ে এই ‘আত্ম’কে নিয়ে বড়ই প্যাঁচে পড়তে হয়। কতটুকু এই আত্মের সীমানা? কতটুকু পরিসর নিরাপদ রাখার শর্তে ‘নিজ’কে রক্ষা করা সম্ভব? মানুষ পরিচয়ের পরিসীমাই বা কতোটুকু? বরাবর এই সকল পচা প্রশ্নে চিন্তা ক্ষত হয়। (প্রবন্ধটি সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘সহজিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
১৯৮০ সালে জাপান গিয়েছিলেন দেরিদা। সেখানকার পণ্ডিতদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, গল্প-গুজব করতে। জাপানি প... more ১৯৮০ সালে জাপান গিয়েছিলেন দেরিদা। সেখানকার পণ্ডিতদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, গল্প-গুজব করতে। জাপানি পণ্ডিতেরা তাকে মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের আসলে দেরিদার তত্ত্ব দরকার নেই। কেন? কেন? প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ, জাপানের নাকি নিজস্ব ধরনের ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ পদ্ধতি আছে। এবং জেন-চর্চাই নাকি তাদের সেই নিজস্ব ঘরানার ‘ডিকনস্ট্রাকশন’। কেননা, জেন-বৌদ্ধদের তৎপরতা মূলত শূন্যেরই কারবারি। দেরিদা যদিও জাপানি পণ্ডিতদের সঙ্গে একমত হননি। কারণ, তখনও নাকি জাপানের অনেককিছুই ‘ডিকনস্ট্রাকট’ করার বাকি। যাইহোক, এই ঘটনা দিয়ে কথা শুরু করার ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আমাদের এখানে যেকোনো চিন্তা বা তত্ত্ব একরকম বিনা বিচারেই আমদানি ও গৃহীত হয়। যতটা পারি আমরা তাকে অক্ষতভাবেই গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নেই। যদি সাধ্যে না কুলায়, চেষ্টা করি সেই তত্ত্বের আলোকে নিজেদেরই বদলে নিতে। এবং সেই বৈদেশি চিন্তাকে আমরা মানি সর্বজনীন সত্যের প্রতিভূ - যা কেবলমাত্র উদ্ধৃতি প্রদানের জন্যই সদা সংরক্ষিত থাকা চাই। তাকে পর্যালোচনা ও ঝাড়াই-বাছাইয়ের মতো শেরেকি কাজ করার সাহস আমাদের কোনোদিনই হয় না। জাপানিদের মতো করে আমরা বলতে পারি না যে - তোমার তত্ত্ব আমাদের লাগবে না - এক্ষেত্রে আমাদের ভিন্ন কিছু বলার আছে। অবশ্য, এটা বলার জন্য আগে তো গড়ে তোলা চাই চিন্তা-চর্চার নিজস্ব জমিন। থাকতে হবে শক্ত পায়ে সেই মাটিতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। এক্ষেত্রে একটা ‘প্যারাডক্স’ কাজ করে। নিজেকে না জানলে পরকে জানা যায় না। আবার পরকে না জানলেও বাকি থাকে নিজেকে জানা। (প্রবন্ধটি সুমন সাজ্জাদ সম্পাদিত ওয়েব ম্যাগাজিন ‘সহজিয়া’তে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি। সংবিধানে আমাদের এই রকম পরিচয়ের কথা বলা আছে (অনুচ্ছেদ ৬.২)। বা... more বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি। সংবিধানে আমাদের এই রকম পরিচয়ের কথা বলা আছে (অনুচ্ছেদ ৬.২)। বাংলাদেশের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে - এটি একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র (অনুচ্ছেদ ১)। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা (অনুচ্ছেদ ৩)। বাংলাদেশ, স্বাধীন, সার্বভৌম, প্রজাতন্ত্র, জনগণ, রাষ্ট্রভাষা, বাংলা ইত্যাদি ধারণাসমূহ অভিধানের সাধারণ শব্দাবলি নয়; বরং গভীর ও ব্যাপক এদের তাৎপর্য। অনেক দাম দিয়ে কেনা। আজ ঈসাই ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির জন্য শহীদ দিবস। গোটা দুনিয়া ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে দিনটিকে পালন করে। আসলে একজন বাঙালির জন্যে শহীদ দিবসকে স্মরণ করা মানে যেকোনো ভাবে উপর্যুক্ত ধারণাসমূহকেই বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কায়দায় বিশ্লেষণ করা। এই প্রবন্ধ ঈসাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক বিবরণ প্রদান না করে, কোন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি মাতৃভাষান্দোলনে শামিল হয়েছিল এবং তা কীভাবে বাঙালিকে একটি রাজনীতি-সচেতন জাতি হিসেবে গঠনে ভূমিকা নেয়, তা উপস্থাপনের কোশিশ করবে। (লেখাটি বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ-এর শিক্ষক পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে পঠিত একটি বক্তৃতা )
Papers by Md. Monirul Islam
প্রথম কথা হলো ‘উপনিবেশ” শব্দটির অর্থ লাতিন বংশোদ্ভূত ইংরেজি ‘কলোনি’ শব্দের ওপর নির্ভরশীল নয়। তেমন... more প্রথম কথা হলো ‘উপনিবেশ” শব্দটির অর্থ লাতিন বংশোদ্ভূত ইংরেজি ‘কলোনি’ শব্দের ওপর নির্ভরশীল নয়। তেমনই এটি তার অনুবাদও নয়। কেননা, খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই ভারতীয় ভাষায় শব্দটির প্রচলন ছিলো। ‘উপনিবেশ’ শব্দটি ‘হরিবংশ’-এ ‘উপনগর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, কালিদাস তার দুটি কাব্যে একই অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ব্যবহার করেন নতুন নগরী সংস্থাপন করা অর্থে। 'উপনিবেশ' যে অর্থ নির্দেশ করে সেই সময়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা তা সত্যায়িত। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এই প্রসঙ্গে আস্ত একটি বই-ই লিখেছেন। অসুবিধা হলো কালিদাস পরবর্তী পর্বে লম্বা সময় ধরে শব্দটি ব্যবহারের আর কোনো নজির পাওয়া যায় না। বর্তমান প্রবন্ধে 'উপনিবেশ' ধারণাটির নিজস্ব ইতিহাস তৈরিতে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি শহীদ ইকবাল সম্পাদিত 'চিহ্ন' পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে।
খালি চোখে দেখলে নিজার লিখেছেন শিল্প-সমালোচনার বই। খুবই পদ্ধতিগতভাবে যেখানে তিনি আলোচনা করেছেন ভার... more খালি চোখে দেখলে নিজার লিখেছেন শিল্প-সমালোচনার বই। খুবই পদ্ধতিগতভাবে যেখানে তিনি আলোচনা করেছেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় শিল্পদৃষ্টির ফারাক - দুইয়ের প্রবণতাগত তারতম্য ও অনন্যতা; উপনিবেশায়নের ফসল রূপে সনাক্ত করেছেন - ভারতশিল্পের অবমূল্যায়ণ ও তার ধারাবাহিকতায় সংঘটিত ছেদ; পর্যালোচনা করেছেন - ভারতশিল্পের বিউপনিবেশায়ন ও তার বহুবিধ সংকট। ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা - নামেই অনেক কিছু আসে যায়। ‘ভারতশিল্প’, ‘উপনিবেশায়ন’, ‘সুলতান’, ‘বিউপনিবেশায়ন’ - বাংলাদেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে শব্দসমূহ মোটেই নিরীহ নয়। এদের রয়েছে সমূহ রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা। শিরোনামে যেন অনেক কথাই বলে ফেলেছেন নিজার। সেই অল্প পরিসরেই প্রকাশ লাভ করেছে তার প্রতিজ্ঞা। অর্থাৎ, তিনি রূপায়ণ করতে যাচ্ছেন, ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া ও উপনিবেশ-পরবর্তী সময়েও তার অটুট প্রভাব এবং সেই প্রভাব বলয়ে সৃষ্ট সংকটের স্বরূপ। এই ধারাবাহিকতাতেই আলোচিত হয়েছে সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা। এই সুযোগে বলে ফেলা যায়, নিজারের গন্তব্য কিন্তু সুলতান নয়। এই কথা মনে রাখার দরকার আছে। সুলতান তার উপায়। সুলতানকে আশ্রয় করে তিনি মূলত গড়ে তুলতে চেয়েছেন অনবদ্য তত্ত্বদৃষ্টি। যেই দৃষ্টিতে সম্ভব হবে গোটা বাংলা-অঞ্চলটাকেই বুঝে নেওয়া; যেই চোখে বাংলা-অঞ্চলের প্রেক্ষিতে একইসঙ্গে বিশ্বকেও নির্ণয় করা যাবে। এই কারণেই সুলতানের শিল্পে প্রকটিত বিউপনিবেশায়ন প্রবণতা নিজারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বিউপনিবেশায়ন তার কাছে রোগনির্ণয়ের তত্ত্ব মাত্র থাকেনি, একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে, বিদ্যমান অস্তিত্বের রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল নির্দেশনা। বাংলা-অঞ্চলের বিউপনিবেশায়ন-তৎপরতা নিজারের তত্ত্বালোচনার ভরকেন্দ্র। বর্তমান আলোচনাটির লক্ষ্যও তাই, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে প্রস্ফূটিত, তার বিউপনিবেশায়ন চিন্তার রূপরেখা প্রণয়ন। সেই সুবাদে তার চিন্তার স্বাতন্ত্র্যও যথারীতি উন্মোচিত হবে। নিজারের প্রস্তাবনা বোঝার ক্ষেত্রে কতোগুলো ধারণা ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাটা জরুরি। এই যেমন ‘আত্মসত্তা’ ও ‘অভিমুখিতা’র প্রত্যয়। তিনি প্রয়োগ করেছেন ‘বিচ্ছেদায়ন’, ‘দ্বি-বিচ্ছেদায়ন’ ও ‘দ্বৈতচিত্ত’-এর ধারণা। প্রত্যয়গুলোর মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক যোগটা ধরতে না পারলে উপনিবেশায়নের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অভিমুখিতা থেকে কীভাবে আত্মসত্তার বিচ্ছেদায়ন ও দ্বি-বিচ্ছেদায়ন ঘটেছে; কীভাবে এর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে দ্বৈতচিত্তের ও সেই প্রেক্ষিতে জন্ম নিয়েছে নানাবিধ সংকট, তা বোধগম্য হওয়া কঠিন। এই রূপরেখাটি না-বুঝলে নিজারের বিউপনিবেশায়ন চিন্তাকে অপরাপর ডিকলোনাইজেশন সম্পর্কিত প্রস্তাবনা থেকে আলাদা করাও মুশকিল। তাই উপর্যুক্ত ধারণাসমূহকে বর্তমান আলোচনায় স্বতন্ত্র পরিসরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বিউপনিবেশায়ন কোনো বিচ্ছিন্ন আলাপ নয়। সারা পৃথিবীতেই ডিকলোনাইজেশন এখন আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন ভূখণ্ডে বিভিন্ন রূপ ও স্বরে সংঘটিত হচ্ছে এই আলোচনা। এইসব আলোচনার মধ্যেকার সম্পর্কের পারস্পরিক ছকটিও সোজাসাপ্টা নয়। তাই বৈশ্বিক পরিসরে সংঘটিত ডিকলোনাইজেশন সংশ্লিষ্ট আলাপালোচনার নজির এখানে টানা হয়েছে; চেষ্টা করা হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটেই নিজারকে বোঝার।
Uploads
Drafts by Md. Monirul Islam
আমি নাম দিয়েছি 'করুণার চল্লিশ সূত্র'। অনুবাদ যথার্থ হলো কিনা এখনও ভাবছি।
‘তাও তে চিং’-এর এখানে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। ভাবকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা। অবলম্বন করা হয়েছে, ক্যারোল দিপ্পি অনূদিত তাও তো চিং-এর ইংরেজি অনুবাদ। এছাড়া তাও তে চিং-এর রুশ সংস্করণ থেকে ইংরেজিতে অনূদিত একটি সংস্করণও ব্যবহৃত হয়েছে। চোখ বুলানো হয়েছে অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদগুলোতেও। (অনুবাদটি খোরশেদ আলম সম্পাদিত ‘শিশিরের শব্দ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিনে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।)
(লেখাটি 'SUSTAIN BD Education & Development Review'-এ ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো)
(বর্তমান আলোচনাটি শিল্প-সাহিত্যের ওয়েব ম্যাগ ‘‘শিশিরের শব্দ’’-এ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিলো।)
Papers by Md. Monirul Islam
আমি নাম দিয়েছি 'করুণার চল্লিশ সূত্র'। অনুবাদ যথার্থ হলো কিনা এখনও ভাবছি।
‘তাও তে চিং’-এর এখানে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। ভাবকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা। অবলম্বন করা হয়েছে, ক্যারোল দিপ্পি অনূদিত তাও তো চিং-এর ইংরেজি অনুবাদ। এছাড়া তাও তে চিং-এর রুশ সংস্করণ থেকে ইংরেজিতে অনূদিত একটি সংস্করণও ব্যবহৃত হয়েছে। চোখ বুলানো হয়েছে অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদগুলোতেও। (অনুবাদটি খোরশেদ আলম সম্পাদিত ‘শিশিরের শব্দ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিনে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।)
(লেখাটি 'SUSTAIN BD Education & Development Review'-এ ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো)
(বর্তমান আলোচনাটি শিল্প-সাহিত্যের ওয়েব ম্যাগ ‘‘শিশিরের শব্দ’’-এ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিলো।)